আজ পদ্মা সেতু স্বপ্ন নয়, বাস্তবে। শত বাধার মুখে সেতুটি মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। এটি বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির মর্যাদার প্রতীক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও দেশের মানুষকে অনেক ভালোবাসেন বিধায় দেশের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।তাঁর মতো মাতা-পিতা, ভাই ও স্বজনহারা প্রধানমন্ত্রী বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই; দেশ ও জনগণকে দেওয়া ছাড়া।
এমনকি তাঁর মতো ধৈর্যশীল নেতাও পৃথিবীতে বিরল। এই পদ্মা সেতুটি শুধু সেতু হিসেবে দেখলে হবে না, এটি বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের সম্মান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগের সুযোগ শতগুণ প্রসারিত করবে। বহুমুখী পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অঙ্গীকার।এই সেতুকে ঘিরে এরই মধ্যে ব্রিজ, কালভার্ট, রেলপথ, নদীর ভাঙন রোধকল্পে নদীশাসনসহ নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
পর্যটন করপোরেশন সেনাঘাঁটি, হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, মিল-কারখানা এবং আবাসিক এলাকাসহ শত শত স্থাপনা, হাট-বাজার গড়ে উঠবে। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় দ্রুততম সময়ে পৌঁছনো সম্ভব হবে। ফলে ৫০ শতাংশের অধিক সময় ও জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে। মুমূর্ষু রোগী ও যাত্রীদের ভোগান্তি কমবে। টাটকা ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু-প্রাণী পৌঁছে যাবে বিনা বাধায়। ফলে মূল্য ক্রেতাদের নাগালের মধ্যেই থাকবে।
চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা ঢাকার চেয়ে গ্রামে আবাসস্থল গড়ে তুলতে আগ্রহী হবেন, ফলে গ্রাম হবে শহর ও উপশহর। এই সময় ঢাকার চতুর্দিকে রিং রোড সম্প্রসারিত হলে দূরপাল্লার গাড়িগুলো সরাসরি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের জেলায় চলে যেতে পারবে, ফলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে হ্রাস পাবে। জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক পদ্মা সেতু। তিনি আরো বলেন, এই সেতুর ফলে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আরো আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে। এই সেতু বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সাফল্যের প্রতীক, এই সেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও সাহসের প্রতীক। এই সেতু দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, এমনকি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিঃসন্দেহে সেতুবন্ধ তৈরি করবে। কর্মসংস্থান বাড়বে হাজার হাজার মানুষের। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিচার্সের ওয়াল্ড ইকোনমিক লিগ টেবিল-২০২১ অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আটটি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশু মৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মন্তব্য করেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত, শিক্ষা সুবিধা, বিদ্যুৎ উৎপাদন সুবিধা, যাতায়াত ব্যবস্থা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস এবং জন্মহার হ্রাস, স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম ও অতি সাম্প্রতিক কভিড-১৯ মোকাবেলায় সফলতা কার্যক্রম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।তিনি আরো বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড-২০১৮’ প্রদান করা হয়। বিশ্বের স্বল্পোন্নত ১৪৭টি দেশের মধ্যে মাতৃ, শিশু ও নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য রোল মডেল দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক জনসভায় মন্তব্য করেন, উন্নয়নের দিক থেকে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম পর্যায়ে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, উপকৃত হচ্ছে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ। ২০০৯ সালে ‘ডিজিটাল’ শব্দটি নিয়ে রসিকতাও করেছেন অনেকে। বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দেশের চার হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার’। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েভ পোর্টাল। এই পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। দেশের সব কটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখের অধিক এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা চার কোটি ৪৬ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট মোবাইল ব্যাংকিং। এর ফলে বেকার যুবক-যুবতীদের আত্মকর্মসংস্থানের পথ সুগম হয়েছে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ অতি ছোট একটি দেশ। তবে অনেক বড় বড় অর্জন ও অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে এ দেশের মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ অনেক পরিশ্রমী। উর্বর মাটির দেশ, সব ধরনের ফসল ও ফলমূল এ মাটিতে হয়। বিভিন্ন দেশে বাঙালিরা সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’—পদ্মা সেতু তারই প্রমাণ। বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে ১৮টি দেশ এগিয়ে আছে, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম এবং অর্থনীতিতে ৭৪টি উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৪তম অবস্থানে। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারই শুধু নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য উন্নয়নের রোল মডেল। এ কারণেই এত সমালোচনা, এত শত্রুতা করেও কিছুই করতে পারবে না। কারণ এ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করছে কে বা কারা কী করতে চায়। সেবা কারা দেয়, কারা দেশের জন্য কতটুকু অবদান রেখেছেন, তা জনগণের ওপরই বিচার্য। শেখ হাসিনা যা বলেন, তা করে দেখান, যা পারবেন না, তা বলেন না। তাঁর যেই কথা সেই কাজ—যার প্রমাণ পদ্মা সেতুসহ সব প্রকল্প। এ দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রাখে। দেশের মানুষ চায় শেখ হাসিনা আরো কয়েকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান, যেহেতু তাঁর কথা ও কাজে মিল রয়েছে। ফলে দেশের উন্নয়নও হয়েছে আকাশচুম্বী। ওপরের আলোচনার সারসংক্ষেপ হলো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বিকল্প অন্য কাউকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাঁর বিকল্প তিনি নিজেই। শক্তি, সাহস, সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা নিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে অদম্য সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। দেশের প্রায় শতভাগ মানুষ তাঁর ওপর আস্থা রাখে। জনগণের পক্ষ থেকে দাবি রইল ভবিষ্যতে যেন দৌলতদিয়া-পাটুরিয়াতে ‘পদ্মা-গঙ্গা-যমুনা’ নামে আরো একটি দ্বিতীয় সেতু হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে যান, সব ক্ষেত্রে আপনার মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলার উত্তরোত্তর উন্নয়ন প্রত্যাশী।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান ও ডিন
মেডিসিন, সার্জারি অ্যান্ড অবসট্রেটিকস বিভাগ
ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স অনুষদ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর